গল্প- কেয়ার অফ ফুটপাথ

।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।। 

 

কেয়ার অফ ফুটপাথ
-উজ্জ্বল সামন্ত

 

 

প্রতিদিনের ন্যায় ভোরের সূর্যের আলো ফুটে উঠেছে। শহরের শুনশান পাকা রাস্তার তেমাথা মোড়ের ধারে একটা বড় ডাস্টবিন দেখা যাচ্ছে। জমাদার হয়তো আজ আসেনি । পৌরসভার ট্রাকের ও দেখা মেলেনি। তাই দুর্গন্ধ দূর থেকে নাকে আসছে। ডাস্টবিনের আশেপাশে খাবারের অনেক প্যাকেট এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কয়েক লক্ষ মাছি ভ্যান ভ্যান করছে। পাশের ফ্লাটবাড়িতে কারও বিয়ে ছিল, হরেক আলোর রোশনাই এখন মিট মিট করে জ্বলছে । সংক্রমনের আশঙ্কার ভয়ে হয়তো অনেকে নিমন্ত্রণ খেতে আসেননি ।খাবার বেড়ে গিয়ে অগত্যা ঠাঁই হয়েছে ওই ডাস্টবিনে। ডজন খানেক কুকুর সেগুলো নিয়ে টানাটানি করছে রাস্তা জুড়ে। লকডাউনে তাদেরও উপবাস চলছে বেশ কয়েকদিন। মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে ঘেউ ঘেউ করছে। মারামারিও করছে কে আগে খাবে। রাস্তার ব্রিজের নিচে থাকা ভিখারিনী ও তার ছোট্ট মেয়েটি ভোর থেকে একদৃষ্টে সেই দৃশ্য দেখছে । ব্রিজের নিচে তার স্বপ্নের অট্টালিকা। বস্তা ও ছেঁড়া চটের আস্তরণে দেওয়াল চারদিকে চারটি বাঁশের লাঠি পোঁতা আছে। পাশে একটি বহু পুরনো ভাঁজ করে রাখা পিচ বোর্ডের পেটি। তিনটি পোড়া কালো ইট ,উনুন হবে হয়তো । দুটি ভাঙ্গা টিনের থালা একটি গ্লাস, একটা দড়িতে টাঙ্গানো একটি শাড়ি ও দুটি নোংরা বাচ্চাদের জামা। ব্যস এই তার সংসার। পরনে শতচ্ছিন্ন শাড়ি । আংশিক লকডাউনে ট্রেন বন্ধ। স্টেশন ও বাস স্ট্যান্ড প্রায় ফাঁকা।অতি মাড়ির প্রকোপে এই ছবি প্রায় সকলেরই চেনা। আগে সারা দিনে ভিক্ষে করে যদি একশো টাকা রোজগার হতো এখন তা একটাকা ও হয় না। দুজনের গত দুইদিন ধরে উপবাস চলছে। দু একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এসেছিল সামান্য চাল ডাল তেল নুন আলু দিয়ে গেছিল। ওই দিয়ে গত তিন-চার দিন চলেছিল। কিন্তু এখন তীর্থের কাকের মতো রাস্তার দিকে দুজনে চেয়ে আছে করুণ দৃষ্টিতে। অপেক্ষা করছে কখন কুকুরগুলো পেট ভরে গেলে এখান থেকে চলে যাবে। উচ্ছিষ্ট কিছু যদি পাওয়া যায়। এখন এই ডাস্টবিনের খাবারই দুজনের বেঁচে থাকার রসদ । ছোট্ট মেয়েটি কাল রাত থেকে খাবারের জন্যে কেঁদে কেঁদে উঠেছিল। মেয়েটির হালকা জ্বরও রয়েছে। ভোরবেলায় ফুটপাতের রাস্তা দিয়ে দু-একজন হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটির মা হাত বাড়ালেও মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। ভিক্ষা দূরের কথা কেউ কাছেই এল না । মেয়েটি আবার বলল মা আমি যাব ওই কুকুর গুলোর কাছে যদি ওদের তাড়িয়ে দু একটা খাবারের প্যাকেট পাওয়া যায়। ওর মা নিষেধ করলো, একদম না। কুকুরগুলো হিংস্র তোকে কামড়ে দিতে পারে। ভুখা পেট তো আর লকডাউন মানে না। মেয়েটি বলল: মা একটু জল খাব ,জল দেবে। বালতির দিকে চেয়ে দেখল জল নেই। তুই একটু এখানে চুপ করে বসে থাক। আমি দেখি আশে পাশের কলে কোথাও জল পড়ছে কিনা। মেয়েটির মা বালতি নিয়ে চলে গেল। এবার মেয়েটি ছুটে গিয়ে হাাঁপাতে লাগল কুকুর গুলোর কাছে। একটি খাবারের প্যাকেট নিতে যাবে অমনি একটা কুকুর ওর দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করলো। হঠাৎ গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। লড়াই মানুষ বনাম পশুর। খাবারের জন্য লড়াই। বাঁচার লড়াই । কয়েক সেকেন্ডের লড়াইয়ে মেয়েটির হাত থেকে রক্ত ঝরছে। কুকুরটি তীক্ষ্ম দাঁত বসিয়েছে। মেয়েটির কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই । মেয়েটির মা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে এক ছুটে সেখানে পৌঁছয়। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা কয়েকটি ইটের টুকরো নিয়ে ছুুঁড়ে মারে। মেয়েটিকে রাস্তা থেকে কোলে তুলে নেয়। প্রচন্ড চেঁচামেচি করে মেয়েটিকে বকতে থাকে। তোকে বারণ করলাম এখানে আসতে। তুই শুনলি না আমার কথা। মেয়েটি এবার সজোরে কাঁদতে থাকে। মা খুব খিদে পেয়েছিল যে। মা লক্ষ্য করে খাবারের প্যাকেটটি মেয়েটির হাতে। সেটি তার কচি হাতের ছোট্ট মুুুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছে। ওখান থেকে মেয়েটিকে কোলে করে কোনরকমে ছুটে চলে আসে নিজের আশ্রয়ে। মেয়েটির হাত থেকে রক্ত ঝরছে এখন কি করবে? কিভাবেই বা হাসপাতালে যাবে ? মা কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটিকে কোলে নিয়ে দৌড়ায় বড় রাস্তার দিকে। সামনে দেখে একটি বাস আসছে কিন্তু প্রচণ্ড ভিড়। হাত দেখালেও বাসটি না থেমে প্রচন্ড গতিতে এগিয়ে যায়। বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে মেয়েটির মা পিছন পিছন ছোটে । হঠাৎ রাস্তার ক্রসিং এ ছুটে আসা একটি গাড়ি সজোরে ধাক্কা মারে। বাচ্চাটিকে নিয়ে মেয়েটির মা ছিটকে পড়ে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। রাস্তার কালো পিচ লাল ।ওই রাস্তায় সকালে দু একজন লোক দাড়াল হাতে বাজারের ব্যাগ, মুখে মাস্ক ঢাকা। কাছে এসে কেউ কেউ মোবাইলে ছবি তুলছে। বাচ্চাটি ফুটপাতে পড়ে রয়েছে। ভদ্রমহিলার কোনো সাড়়া শব্দ নেই। বাচ্চাটির চোট লেগেছে। দুটি বৃহন্নলা দূর থেকে এক্সিডেন্টটা দেখে ছুটে আসে। একজন জলের বোতল খুলে মেয়েটির মায়ের মুখে জল দেয়। নাকের কাছে হাত রেখে দেখে নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা। না তার কোনো লক্ষণ নেই। সাহায্যের জন্য দু একজন কে এগিয়ে আসতে বললে জায়গাটা দ্রুত ফাঁকা হয়ে যায়। ১০০ ডায়ালে ফোন করলে ফোন রিঙ হয়েই যায়। বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুতপায়ে হন হন করে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে চলে আরেকজন। একটা জীবন শেষ হয়ে গেল চোখের সামনে, যদি এই নিষ্পাপ শিশুটি কে বাঁচানো যায় সেই প্রত্যাশায়।

Loading

Leave A Comment